নীতিশ এসিটা চালিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। বড্ড গরম বাইরে। শনিবার। হাফ-ডে অফিস। তাড়াতাড়ি ফিরেছে। লাঞ্চ করে বউকে পাশে নিয়ে বিছানায় গল্প করতে-করতে ঘুমিয়ে পড়বে, এই ছিল ভাবনা।
কিন্তু চিত্র অন্য হয়ে গেল। সুরভি বলল, ‘ভাত খেয়ে ঘুমতে যাও। আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি পাশের ঘরে শোব। এখন কিছুটা একা থাকতে চাইছি।’
দু’দিন আগের ঝগড়াটা নীতিশের মনে ভেসে এল। অফিসের অধস্তন মহিলা কর্মী শুভ্রা ফোন করেছিল সেদিন সন্ধ্যায়। ওর আর নীতিশের আধঘন্টার ফোনালাপ আড়ি পেতে শুনেছিল সুরভি।
ফোনের ওপার থেকে শুভ্রার একটা কথাই সুরভির সন্দেহকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। ফোন থেকে কিছুটা দূরে থাকায় সুরভির কানে ক্ষীণ হয়ে হলেও ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি নীতিশদা’ এই কথাটা পৌঁছেছিল।
নীতিশ কথা শেষ করে ফোন রাখল। সুরভি ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘তাহলে ডুবে-ডুবে জল খাওয়া! তোমাকে ভালো বলে জানতাম। এখন দেখছি সর্ষের মধ্যে ভূত। ঠিক আছে। আজ থেকে তোমার সুরভি বদলে গেল। এটা ভেবে নিও।’
সেই শুরু ঝগড়ার। নীতিশ দু’-হাতে সুরভিকে ধরে বোঝাতে লাগল, ‘সুরভি, তোমার ভুল হচ্ছে। আমার কথাটা শুনলে তোমার ভুল ভেঙে যাবে। আগে শোনো তো, আমি কী বলি।’
‘তোমার একটা কথাও আমি শুনতে চাই না। আমার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে।’
‘বলি কী বুঝেছ?’
‘আজ এই নিয়ে পনের দিন হচ্ছে তুমি ওই শুভ্রা নামের মেয়েটার সাথে কথা বলছ। ঠিক সন্ধে সাতটা বাজলেই ফোন। কী এমন দরকার থাকে যে রোজ ও তোমাকে কল করে। আমি ন্যাকা নই। পরকীয়া চালাচ্ছ। প্রমাণও হয়ে গেছে।’
‘কেমন প্রমাণ?’ মৃদু বিস্ময় নীতিশের।
সুরভি আরও আগুন হয়, ‘বলেই তো দিল, নীতিশদা আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তো নিজের কানে শুনলাম। এর থেকে বড় প্রমাণ আর কী হয়? দেখবে যেদিন সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যাবে সেদিন হারিয়ে যাব তোমার জীবন থেকে। শুধু তোমার জীবন থেকে নয়। পৃথিবী থেকে একেবারে।’
নীতিশ শান্ত হয়। বলে, ‘তুমি যা ভাবছ আসলে তা নয়। আর আসলে কী সেটা সময় হলে জানবে। অপেক্ষা করো।’
‘ওসব নাটক বন্ধ করো। তার চে’ বরং তুমি এক কাজ করো। আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। ছেলেমেয়ে তো হয়নি এখনও আমাদের। ফলে আমার বা তোমার কারও তেমন সমস্যা হবে না ভবিষ্যৎ নিয়ে। তুমি ওই শুভ্রাকে বিয়ে করে নাও। আর আমার কপালে যা আছে হবে। নাহয় ঘুঁটে তৈরি করে, ভিক্ষে করে পেটের ভাত করে নেব। আমার বাবা-মা তো কেউ নেই, তাই। আমাকে একার চেষ্টায় একা বাঁচতে হবে নাহয়।’
নীতিশ বলল, ‘আবোলতাবোল বোকো না। এমন উল্টোপাল্টা চিন্তা বাদ দিয়ে ভাবো সামনের দিনগুলোতে আমরা কী প্ল্যানিং করে রেখেছি। বাড়িটার একটু এক্সটেনশন করতে হবে। তারপর একটা গাড়ি কিনতে হবে। একটা ফুটফুটে সন্তান আসবে আমাদের ঘরে। হাসিখুশিতে আমাদের ফ্যামিলি ভরে উঠবে।‘
‘চাই না আমি অমন সংসার। অমন সুখ। সংসার করতে হয় করো তোমার ওই শুভ্রাকে নিয়ে। আর সেটাই তো মনে মনে ভেবে রেখেছ। তাহলে কেন আমায় মিছিমিছি এখানে বন্দি করে রেখেছ?’
সুরভির এই কথাই নীতিশ একচোট হেসে নিল। তারপর বলল, ‘কী বললে, তোমায় আমি বন্দি করে রেখেছি? এটা বলতে পারলে? চলো আজ সিনেমায় যাব। ‘স্বপ্না’ সিনেমা হলে ভালো একটা বাংলা ফিল্ম এসেছে। ফিল্মের নাম – অনুরাগ। দেখে আসব দু’জনে। তারপর হোটেল থেকে পেটপুরে বিরিয়ানি খেয়ে আসব। আর হ্যাঁ, মাকে ওষুধটা খাবার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলে?’
আজ আবার মনকষাকষি। রাতে ডিনার সেরে নীতিশ ওদের বেডরুমে চলে গেল। সুরভি এল না। পাশের ঘরে শুলো। শাশুড়ি থাকেন আর একটা ঘর পরে। ওদের একতলা বাড়িটাতে মোট পাঁচটা বেডরুম। বড়সড় বাড়ি। নীতিশ ঠিক করেছে সামনের বছর নিচে আর একটা ঘর বাড়িয়ে ওপরটায় হাত দেবে। ওর খুব ইচ্ছে বাড়িটাকে দোতলা বানাবে। কিন্তু সুরভি যা শুরু করেছে তাতে সেদিকে নীতিশ যে মনই দিতে পারছে না।
পরদিন নীতিশ অফিসে চলে গেল। শুভ্রার সাথে একঘন্টা অফিসের এক কোণায় বসে কীসব কথাবার্তা বলল। শুভ্রা খুব মন দিয়ে কথাগুলো শুনল। নিজেও কিছু বলল। এই অফিসে নীতিশ বস। ওর অধীনে ষোল জন কর্মী কাজ করেন। নীতিশের মতো বসকে পেয়ে কর্মীরা নিজেদেরকে ভাগ্যবান ভাবে।
নীতিশ সব সামলাল। শুধু নিজের ঘরের শান্তিটাকে বজায় রাখতে পারল না।
অফিস থেকে ফিরে সে দুটো খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। চুপ করে শুয়ে রয়েছে কপালে হাত রেখে। যেন গভীর কোনো চিন্তা এসে তাকে ধরেছে। সুরভি একটা সোয়েটার বুনছিল করিডরে। হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে উঠল।
ছুটে গিয়ে কল রিসিভ করল। অচেনা নম্বর। ফোন ধরতেই একটি মেয়ে বলল, ‘আমি শুভ্রা। আপনার হাজ়ব্যান্ডের অফিসের কর্মী।‘
‘হ্যাঁ বলুন।‘ সুরভি বলে। কিন্তু তার মনের ভেতরে যেন হঠাৎ একটা আগুনের শিখা ঝলক দিয়ে গেল। রাগে মাথাটা যেন পুড়ে যেতে লাগল।
শুভ্রা বলল, ‘কাল আপনি নীতিশদার সাথে বাবার নার্সিং হোমে চলে আসবেন। আপনার অপারেশন হবে। কিডনি ট্র্যান্সপ্ল্যান্টেশন। আর হ্যাঁ, আমি শুনলাম আপনার বাড়িতে আমাকে নিয়ে অশান্তি চলছে। বলে রাখি আমি এক সপ্তাহ পর আমেরিকা চলে যাচ্ছি। সাত বছরের জন্য। ওখানেই চাকরি নিয়েছি। আমার আর নীতিশদার সম্পর্কের ব্যাপারে বলি, আমি সত্যিই নীতিশদাকে ভালোবাসতাম। মনে মনে চাইতামও। কিন্তু আপনার স্বামীটি বড় কড়া মনের আর চরিত্রবান। আমাকে বরাবর বলে এসেছে, ও আমাকে বন্ধুর চোখে দেখে। এছাড়া আর কিছু না। আপনি ভাগ্যবতী ওরকম একজন স্বামী পেয়েছেন। তাই অকারণে আর সন্দেহ করবেন না ওকে। আমি ওকে ফোন করতাম আপনার চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলতে। বাবা আমাকে কিছু কিছু ইনফরমেশন দিতেন। সেগুলো আমি ফোন মারফত নীতিশদাকে জানাতাম।‘ বলে ফোন কেটে দিল শুভ্রা।
সুরভি ভাবতে বসল, এটা সত্যি, তার ডানদিকের কিডনিটা নষ্ট হয়ে গেছে। শুভ্রার বাবার নার্সিং হোমে তার ট্রিটমেন্ট চলছে। আর নীতিশের ব্যাপারে শুভ্রা যা বলল তাতে আনন্দিত না হয়ে পারল না সুরভি।
ঘরে দিয়ে সুরভি দেখল, নীতিশ বিছনায় পাশ ফিরে। তার দু’চোখ থেকে জল ঝরছে।
সুরভি জিজ্ঞেস করল, ‘কাঁদছ?’
নীতিশ বলে, ‘হ্যাঁ কাঁদছি। কাঁদছি আমার জীবন নিয়ে। এত দুঃখ ছিল এই জীবনে!’
সুরভি বলল, ‘সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে।‘
‘কীসের ভুল?’
‘শুভ্রা ফোন করেছিল। সব বলল। তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও। কাল আমার অপারেশন?’
‘আমি অভিজিৎ কাকুকে ফোন করছি। যদি কয়েক দিন পেছানো যায়।‘
নীতিশ ফোন করতেই ওর কথা শুনে অভিজিৎবাবু মানে শুভ্রার বাবা বললেন যে, দিন পাঁচেক পর হলে অভিজিৎবাবুরই কিছুটা সুবিধা হয়। আগামী সোমবার অপারেশনের দিন নির্দিষ্ট হল।
শুভ্রা স্বামীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে রইল। বলল, ‘অ্যাই, আমি মারা যাব না তো? আমার খুব ভয় করছে।‘
নীতিশ বলল, ‘কিচ্ছু নেই ভয়ের। শুভ্রার বাবা বিলেত ফেরত ডাক্তার। অপারেশনে দারুণ এক্সপার্ট। খুব নামডাক আছে। বরং তুমি অপারেশনের পর একটা সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করতে পারবে। আর একটা কথা, ওইসব আজেবাজে সন্দেহমূলক চিন্তাভাবনা করা যাবে না। আমাদের মনের ওপর শরীর অনেকাংশে নির্ভর করে। যদি ভুলভাল চিন্তা করে ব্রেন আর নার্ভকে অসুস্থ করে তোলো তাহলে শরীরের ওপর তার প্রভাব পড়বে। অসুখ করবে। তাই মন ভালো রাখতে হবে। ভুলভাল চিন্তা করা যাবে না। শুভ্রা কী বলল?’
‘বলল তোমার স্বামীটি বড্ড ভালো। আপনি ভাগ্যবতী, ওকে পেয়েছেন। সত্যি আমি তোমায় কত ভুল বুঝেছিলাম। দেখো আর তোমাকে আমি ওরকম ভাবব না। অপারশেন হয়ে গেলে আমি সুস্থ হয়ে যাব। তারপর বাড়িটাকে বড় করার চিন্তাভাবনা করব দু’জন। তারপর একটা বাচ্চাকাচ্চা নেবার কথা ভাবব। একটা গাড়ি কেনার ব্যাপারেও ভাবতে হবে, কী বলো?’
নীতিশের মনটা আজ জুড়িয়ে যেতে লাগল।
সে সুরভির মাথাটা বুকে চেপে ধরে রইল।
বসন্ত বাতাস নীতিশের হৃদয়ে ভালোবাসার পরশ লাগিয়ে বয়ে যেতে লাগল।
আজ তার সুখের দিন। প্রেমের ক্ষণ।
প্রেম আর সংশয়ের লড়াইয়ে প্রেম জিতে গেল।
সমাপ্ত