পার্থর মনটা ভালো নেই। আরে বাবা, বউ ঘরে থাকবে, যা লাগবে এনে দেবে। ঘরের কাজ করবে। সংসার চলবে। এটাই তো নিয়ম নাকি! নাকি সে যাবে চাকরি করতে! চাকরি করার প্রসঙ্গ আসত। অবশ্যই আসত। যদি স্বামীর তেমন রোজগার না থাকত। কিন্তু পার্থর তো তা নয়। মাস গেলে এই সময়ে ও একেবারে কড়কড়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘরে আনে। তাহলে? তাহলে কেন এমন বেহায়াপনা চাকরি করতে যাবার জন্যে?
নিশ্চয়ই চরিত্রে দোষ আছে। বাইরে না গেলে ফষ্টিনষ্টিটা হবে কেমন করে। এই তো ব্যাপার। পার্থ কি আর বোঝে না? নাকি বাচ্চা আছে ও। যাক। গেছে ভালোই হয়েছে। আর একটা বিয়ে করবে পার্থ। বয়েস এখনও পেরিয়ে যায়নি। অমন সরকারি চাকরি। অমন বেতন। রূপসী মেয়েরা তুড়ি দিলে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে। আপদ গেছে যাক।
তবু তো একটা বাচ্চাকাচ্চা হয়নি এখনও। নইলে কী বিপত্তি যে হত বলে বোঝানো যাবে না কাউকে। বেটির ইজ্জত বলে কিছু নেই। সকাল হলেই লোকের বাড়ি গিয়ে উঠবে। নিজের তো এমন একখানা একতলা মার্বেল বসানো পাকা বাড়ি রয়েছে। সেখানে থাকা যায় না। খালি এর বাড়ি তার বাড়ি করে বেড়াতে হবে?
ওর বাপ যেমন মেয়েও তেমন হয়েছে। বাপ তো প্রমোটারি করে মোটা টাকা হাতাচ্ছে। চারদিকে তো মস্তানি করে বেড়ায়। মস্তানের মেয়ে আবার কেমন হবে? আর এ বাড়ি মুখো হোক তখন ঝ্যাঁটা মেরে বিদেয় করতে হবে।
এইসব নানান বাস্তব অবাস্তব ছোটবড় সব চিন্তা করতে-করতে পার্থ ঘুমিয়ে পড়ল। ওদিকে মোবাইলে রিল দেখতে-দেখতে সুপ্রিয়ার রাত কাটতে থাকে নবাবগঞ্জের দোতলা বাড়িটার ওপরের ঘরে। বাবা হিরন্ময় বলে দিয়েছেন, “তোর ইচ্ছে হলে ওখানে যাবি। না ইচ্ছে হলে যাবি না। সবটা তোর মর্জির ওপর ছেড়ে দিলাম।“
সুপ্রিয়ার এখন নিতান্ত মরিয়া অভিপ্রায় সে ডিভোর্স নিয়ে নেবে। আর কোনও চিন্তাভাবনা নয়। নিয়ে অন্য কোনও ছেলেকে বিয়ে করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে। অমন সরকারি চাকরিওয়ালা ছেলে আজকাল একটু চোখকান খোলা রাখলে অনেক দেখা যায়। পার্থ অবশ্য হ্যান্ডসামও কম ছিল না। তাতে কী? হ্যান্ডসাম আর প্রতিষ্ঠিত ছেলের কি আকাল পড়ে গেছে এই কলকাতায়? মোটেই না। সুতরাং চিন্তা কিছু নেই। একটার পর একটা ভিডিও স্ক্রল করে-করে দেখতে থাকে সুপ্রিয়া। ও তো নিজেই এমএমসি পাস। কেমিস্ট্রি নিয়ে। পার্থ অবশ্য আরও কোয়ালিফায়েড। ব্যাটা ফিজিক্সে ডক্টরেট। সব ভালোই ছিল ছেলেটার। কেবল কিছুটা রক্ষণশীল প্রকৃতির। আজকাল মেয়েরা ঘর বাহির দুটোই তো সামলাচ্ছে। কই তারা সব খারাপ হয়ে গেছে? নাকি তাদের সংসারে আগুন জ্বলে গেছে। পার্থটা একেবারে গবেট ছেলে ছিল। নইলে ওই সামান্য কারণে ওকে ছেড়ে দেয়। বলে চলে যাও বাপের বাড়ি। এখানে তোমার জায়গা নেই। এ কী ছেলে রে বাবা! সেই আদ্যিকালের লোকই বলা যায়। একটা সায়েন্স ডক্টরেট মানুষের এমন চিন্তাভাবনা! ছ্যাঃ। যাক গে। ওরম ছেলের সাথে সংসার করার থেকে ডিভোর্সি হয়ে বাবার ঘরে বসে থাকা অনেক মর্যাদার। যাবে না সুপ্রিয়া পার্থর বাড়িতে।
আর ওর মা’টাকে বলিহারি! ছেলের বিরুদ্ধে একটা কথা নেই মুখে! কী আশ্চর্য! খালি একটাই বাক্য, “এ ব্যাপারে পার্থ যা ভাববে তাই। আমার কোনও কথা নেই।”
ওর বাবা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এর একটা হেস্তনেস্ত হতই। যে ছেলে মায়ের কাছে আশকারা পায় নিশ্চয়ই বাবার কাছে কড়া শাসনে থাকে। ভাবে সুপ্রিয়া। আর ভেবে হবেই বা কী। কপালে নাইকো ঘি, ঠকঠকালে হবে কী। কপালে যে সুখ লেখা নেই। নাহলে অত খেটেখুটে ডিস্টিংশন নিয়ে মাস্টার্স করে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে এসে বাবার কাছে বাবার বোঝা হয়ে থাকতে হচ্ছে?
এই তো ক’দিন আগে পার্থ ওকে এমন মার মেরেছে যে উচিত ছিল সেদিনই চলে আসা। তবুও তারপর বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে সুপ্রিয়া ওর ঘরে। এত সহ্যকারী মেয়ে কোথায় পাবে ওর মতো একটা বাউন্ডুলে ছেলে। হতে পারে বিশাল ডিগ্রিধারী। বাড়ি ফেরে তো রাত ন’টার কমে নয়। পীরিতে বন্ধুগুলোর সাথে আড্ডা না দিয়ে বাড়ি ফিরলে যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। মদ-টদও গেলে বোধহয়। দুর্গাপুজোর বিসর্জনের পরদিন তো মাতাল হয়েই ঘরে ঢুকেছিল। সুপ্রিয়া বলেছিল বলে ওকে বলেছে, “তোর বাপের টাকায় মদ খেয়েছি হ্যাঁরে?” সুপ্রিয়া কিছুই বলেনি। কারণ ওকে ভালোবাসত সুপ্রিয়া। একটু-আধটু মদ খেলে কী হবে বিরাট দিলদরাজ ছেলে পার্থ। বিরিয়ানী খাব বললে সুপ্রিয়ার জন্য এক প্লেটের জায়গায় তিন প্লেট এনে হাজির করত মাহাতোর মোড়ের ওই বড়সড় রেস্তোরাঁটা থেকে।
আজ সুপ্রিয়ার বড় কষ্ট হচ্ছে। ও হলফ করে বলতে পারে ওদের মধ্যে ভীষণ ভালোবাসা ছিল। তা সত্তেও আজ ওরা দু’জন দু’জায়াগায়। এর নাম বোধহয় নিয়তি।
আর-একটা কথা ভাবলে কান্না আসে সুপ্রিয়ার। সে রাতে ওর জ্বর ছিল। পার্থ সারাটা রাত জেগে বসে ছিল ওর পাশে। কখনও মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে তো কখনও হাত পা টিপে দিচ্ছে। আজও সুপ্রিয়া পার্থর হাতে সেই স্পর্শ যেন অনুভব করতে পারে মনে-মনে।
সুপ্রিয়া হাতের কুড়ি হাজার টাকার মোবাইলখানা ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। ঠিক এই সময়ে ওর মা শোভাদেবী ওর ঘরে প্রবেশ করেন। বলেন, “কেনই বা চলে এলি? আর কেনই বা কাঁদবি? পার্থ জিনিয়াস। আর জিনিয়াসদের মধ্যে পাগলামি অল্পস্বল্প থাকে। ও চাইছে না চাকরি করবি না। ব্যস। মিটে গেল। ক’দিন পর ও প্রফেসর হয়ে যাবে। কত টাকা লাগবে তোর? নেট কোয়ালিফাই করে তো বসে আছে। ইন্টারভিউও দিয়ে এসেছে। আমায় বলেছে চাকরি ওর হবেই। ছেলেটা বড্ড ভালো ছিল রে! তোর কপাল তুই কেটে ফালা-ফালা করছিস। ফিরে যা। ওর কাছে চলে যা। নিজের ঠিকানায় যা।”
“মা, আমি মরে গেলেও ওর কাছে যাব না,” সুপ্রিয়া ককিয়ে কেঁদে ওঠে।
শোভা বলেন, “যাবি না বেশ। তাহলে কাঁদছিস কেন পাগলের মতো? ও-ই তোর ঠিকানা। তোকে যেতেই হবে। তুই মিলিয়ে নিস। এই দুধ রাখছি খেয়ে শুয়ে পড়িস। রাতে এরকম না খেয়ে খেয়ে ঘুমতে গেলে শরীর আর শরীর থাকবে না বলে দিলাম।”
মস্ত কাণ্ড বাধিয়ে এসেছে সুপ্রিয়া। দিন বারো আগে ঝগড়ার সময় পার্থর গালে চড় মেরে এসেছে। পার্থ কিছুই বলেনি। রাতে ঘুম ভেঙে সুপ্রিয়া পার্থর ক্রন্দনরত চোখদুটোই অন্ধাকারে আবিষ্কার করেছিল। তারপর হাজার আদর দিয়ে ওকে ভুলিয়েছিল সুপ্রিয়া। পার্থর পা ছুঁয়ে বলেছিল, “এমন কাজ যদি আবার হয় পার্থ যেন ওকে নিজে হাতে শেষ করে শ্মশানে শুইয়ে দিয়ে আসে।” পার্থ ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরে শুধু বলেছিল, “এমন কথা একদম নয়। আমি জানি ইউ লস্ট ইওর কন্ট্রোল দ্যাট টাইম।” সেইসময় সুপ্রিয়া ওর বুকে মাথা গুঁজে অনেক কান্না করেছিল।
এমন প্রেমের পরিণতি আজ বিচ্ছেদ। আহা! যে শুনবে প্রাণ জ্বালা করে উঠবে তার। সুপ্রিয়া অতি সুশ্রী মেয়ে। শুধু সুশ্রী নয়। গুণও অনেক। ভালো ছবি আঁকে। কবিতা লিখতে পারে। ভালো রান্না করে। নাচও জানে দারুণ। মাঝেসাঝে রিল বানিয়ে ছাড়ত সোশ্যাল মিডিয়াতে। কত যে ফলোয়ার ওর। সেখান থেকেও মাস গেলে কিছু আসত। রিল বানানোতে যদিও পার্থ তেমন আপত্ত করত না। বলত, “যা করলে তোমার মন ভালো থাকে করো। অসুবিধে নেই। কিন্তু চাকরি, ওই জিনিসটির কথা মুখে এনো না।”
সুপ্রিয়া বলত, “আমার এত ভালো রেজাল্ট? সেগুলোর কী হবে?”
পার্থ বলত, “আমাদের যে ছেলেমেয়ে হবে তাদের মানুষ করবে সেই বিদ্যে দিয়ে। তারা ভালোই মানুষ হবে।”
সুপ্রিয়া চুপ। কিছু বলে না।
আজ একটা ভীষণ তীব্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও নিজের জীবন নিয়ে। বাবা আর মাকে জানিয়ে দিয়েছে ও ডিভোর্স চায়। আর কোনও কথা নয়। সামনের মাসে অর্থাৎ এপ্রিলের দশ তারিখে কোর্টে গিয়ে আইনী ডিভোর্স নিয়ে নেবে। পার্থকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছেন সুপ্রিয়ার বাবা।
পার্থ ডেসপারেট ছেলে। ও মন থেকে ঠিক করে নিয়েছে, যা হবার তা হবে। নাহয় বিচ্ছেদ হবে। কত লোকেরই না হয়, আর এ অবধি হয়েছে। নাহয় ওর জীবনেও তাই হবে।
তিন দিন পর সুপ্রিয়া একটু কেনাকাটা করার জন্যে গড়িয়াহাট গিয়েছে। একটা শাড়ির দোকানে শাড়ি দেখছে। ফুটপাথ লোকে যেন থিকথিক করছে। কিচিরমিচির কিচিরমিচির আওয়াজ সব মানুষের। এমন সময় সুপ্রিয়ার চোখ পড়ল একটু দূরে ওরই দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের ওপর। আরে এ যে পার্থ!
ছেলেটা নির্নিমেষ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে। চোখদুটো যেন জন্মজন্মান্তরের প্রেমকাহিনি প্রকাশ করে দিচ্ছে আগুনের ভাষা দিয়ে। সে আগুন যেন নিভতে গিয়েও নিভছে না। লেলিহান শিখা অবশ্য তাতে নেই। যেন একটা মরিয়া আকুলতা সেই চাহনির মধ্যে অসহায় ভঙ্গিতে আনমনে খেলা করে বেড়াচ্ছে।
সুপ্রিয়ার চোখ ফেটে জল আসতে চাইল। সামাল দিতে পারল না নিজের আবেগকে। বাঁধ যেন ভেঙে যাচ্ছে জলের তোড়ে। ও ছুটে গিয়ে পার্থকে জড়িয়ে ধরল। ওর বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠল ককিয়ে। সেই অতি পরিচিত প্রণালীতে। পার্থও ওকে বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। বলল, “আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?”
সুপ্রিয়া উচ্চারণ করল, “কোনওদিন নয়।
পথের কিছু লোক এ দৃশ্যের সাক্ষী রইল। আর সাক্ষী রইল ওই আকাশের তপ্ত সূর্যটা, তাকে ধরে আছে যে আকাশটা, সেও।
সুপ্রিয়া পার্থর হাত ধরে পার্থর বাড়ির দিকে পা বাড়াল। চাকরি নাহয় সুপ্রিয়া নাইবা করল।
ফুটপাতের একটা পাখির দোকান থেকে খাঁচার মধ্যে একটা সবুজ টিয়া ডেকে উঠল – টিয়া টিয়া টিয়া! যেন বলতে চাইছে – দারুণ তো! দারুণ তো!
সুপ্রিয়ার কোমল হাতের ছোঁয়ার আবার ঢেউ উঠল পার্থর পলাতক মনে!
দঃ ২৪ পরগণা, কলকাতা