আজ ঈদ। ঈদ-উল-ফিতর। গতকাল সন্ধ্যা হতেই পাড়ায় ধুম লেগে গেছে। কাল সন্ধ্যায় সবার বাড়িতে সিমুই ভাজা হল। মশলা রেডি করা হল। মেয়েরা হাতে হাতে সবাই মেহেন্দি পরল। পাড়ায় রাস্তা রঙিন আলোর রোশনাইয়ে ভরে উঠেছিল।
দাদুরা দাদিরা তাদের নাতিনাতনিদের হাত ধরে, আব্বারা তাদের কচি-কচি ছেলেমেয়েদের হাত ধরে পাড়ার রাস্তায় হেঁটে-হেঁটে লাইটিং দেখাচ্ছিলেন।
মন্ডলপাড়ার পথটা সেই মসজিদের আগ হতে এপারে একেবারে পাড়ার শেষপ্রান্ত পর্যন্ত, মানে পুরো পাড়ার রাস্তাটা বিচিত্র রঙের টুনিল্যাম্পের আলোয় ঝিকমিক করতে লাগছিল। যেন মনে হচ্ছে এ গ্রামটার ওপর জান্নাতি রূপের ছটা এসে পড়েছে। আহা! চোখ জুড়িয়ে যায়।
রাত এগারোটা অবধি বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা মেয়েরা বাজি ফাটিয়েছে রাস্তায় রাস্তায়। অবশ্য প্রচণ্ড আওয়াজের বিপজ্জনক বাজি কারওরই হাতে দেয়নি ওদের বাড়ির লোকেরা। শিশুদের উপযোগী বাজি আর আলোবাজি যেমন রকেট, তুবড়ি, চরকি, ফুলঝুরি, রং মশাল এইসব বাজি ওরা ফাটিয়েছে। এগুলো পোড়ানোতে বড়রা অবশ্য ওদের সাহায্য করেছে। ছোটো ছোটো বাজি যেমন পপ, সাপবাজি এগুলো ওরা নিজে হাতে ফাটিয়েছে। এতে বিপদের ঝুঁকি তেমন নেই তাই।
ক্লাস ফোরে পড়া ছেলে করিম ছুটে এসেছে ওরই ক্লাসমেট জিসানের বাড়িতে, “এই জিসান, কাল ক’টায় নামাজ রে?”
“কেন, ঈমাম সাহেব মাইকে হেঁকে দিল, শুনিসনি?” জিসান বলে।
“না রে। আমি সেইসময় পপ ফাটাচ্ছিলাম। ওদিকে খেয়াল হয়নি,” করিম বলল।
জিসান বলল, “সকাল আটটায়। তুই নামাজ পড়তে যাবি তো?”
“যাব না মানে। সেই ভোর থাকতে উঠে পড়ব ঘুম থেকে। গোসল করে রেডি হয়ে থাকব,” করিম বলল।
জিসান বলল, “আমায় ডাকিস। একসাথে মসজিদে যাব।”
জিসানের আব্বা রহমত মন্ডল এলেন বাজার থেকে। এটা ঈদের আগের দিন সন্ধেবেলা মানে চাঁদরাতের কথা। মাংস এনেছেন। লাচ্ছা এনেছেন। মিষ্টি কিছু এনেছেন। আর বড় বড় চার বোতল ঠান্ডা পানীয়। কাল অতিথিরা আসলে দিতে হবে যে। জিসানের মা সালমা সেগুলো তুলে যথাস্থানে রেখে দিয়ে জিসানকে বললেন, “ওরে জিসান, সুমাইয়া কোথায় গেল দ্যাখ তো…সেই একঘন্টা আগে বেরিয়েছে ওর রুবিবাআপার কাছে মেহেন্দি করতে যাবে বলে। এখনও এল না কেন যে!” জিসান “যাচ্ছি মা” বলে একদৌড়ে বার হয়ে গেল। গিয়ে দেখল রুবিনাআপাকে ঘিরে ধরে বসে আছে একদল বাচ্চা মেয়ে। আর রুবিনাআপা একজনের হাতে মেহেন্দি করে দিচ্ছে। জিসান গিয়ে ডাক দিল, “এই সুমাইয়া…”
অপেক্ষাকৃত বড় মেয়ে কলেজে পড়া রুবিনা বলল, “এই জিসান দাঁড়া আর একটু। মিনিট তিনেক লাগবে এই আফরিনেরটা কমপ্লিট করতে। তারপর সুমাইয়াকে করে দিচ্ছি।” জিসান বলল, “ও আপা, আমার হাতে করে দেবে মেহেন্দি?” রুবিনা বলল, “বোস তাহলে? কী খাবি বল জিসান? সিমাই তো কাল। আজ এখন মিষ্টি খাবি বল। তোর বড়মাকে বলে আনিয়ে দিচ্ছি।”
জিসান বলল, “কিচ্ছু খাব না। আমার আর আমার বোনের হাতে শুধু দারুণ করে মেহেন্দি করে দাও আপা তুমি।” রুবিনা পাশ থেকে একটা বাটি টেনে নিয়ে জিসানের সামনে আগিয়ে দিয়ে বলল, “তাহলে এই খেজুর ক’টা খা। মিষ্টি খাবি না যখন।” জিসান বলল, “আপা এদের দাও।” রুবিনা বলল, “এরা সবাই খেয়েছে। চারটে করে দিয়েছি। গোটা পাঁচেক আছে আর। ওগুলো তুই খেয়ে নে। খেয়ে একটু ওয়েট কর। করে দিচ্ছি মেহেন্দি। সুন্দর করে করে দেব। যে দেখবে ভালো বলবে।”
রুকসানা নামে একটি মেয়ে ওদের মধ্যে থেকে বলে উঠল, “আমাদেরটা সুন্দর হবে না তাহলে আপা?” রুবিনা বলল, “কেন হবে না? সবারই সুন্দর করে করে দেব। খুব সুন্দর করে।” রুকসানা হাঁফ ছাড়ল, “তাই বলো। আমি তো ভেবেছিলাম…”
মুরগির দোকান দিয়েছে করমালি শেখ। মন্ডলপাড়ার তরুণ সংঘ ক্লাবের একটু আগে। হরদম বিক্রি হচ্ছে। লোকের সে কী ভিড়! বাবা রে বাবা! করমালি আর ওর ছেলে বিক্রি করছে। করমালি মাথায় টুপি দিয়ে দোয়া বলে একটা করে মুরগি কাটছে। মাংস ছাড়াচ্ছে আর পাল্লায় মেপে কাস্টমারদের হাতে পলিথিন ব্যাগে করে মাংস তুলে দিচ্ছে। আর করমালির ছেলে জবেদ হিসেব করে ওদের থেকে দাম বুঝে নিচ্ছে। এপারে আসমত জমাদার নারকেল নিয়ে বসেছে। হু হু করে সেল হচ্ছে। মগরিবের নামাজ পড়ে এসে এরা সবাই দোকান খুলেছে। মুরগির মাংস যেমন সেল হচ্ছে সেইসাথে নারকেলও। সিমাই বানাতে গেলে যে নারকেল চাই প্রত্যেকের ঘরে ঘরে।
তার একটু আগে রহিম দিয়েছে কাপড়, আতর, সুরমা আর বাজির দোকান। বাজিগুলো দোকানের সামনে একটা ঝুড়িতে খোলা রাখা। বাচ্চারা কিনছে। বাচ্চাদের মায়েরা রহিমের দোকানে এসে নানান প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন পোষাক-আশাক, চুড়ি দুল এইসব কিনছে।
সকাল হল। সবাই সাজ-সাজ রব। মসজিদে নামাজ হবে। ঈদগা বিশাল। সেখানে কত রকমভাবে সবকিছু যে সাজানো হয়েছে তা বলে বোঝানো যাবে না। আশপাশের পাড়া থেকে লোকেরা এই মন্ডলপাড়ায় ঈদগাহ দর্শন করতে আসে। মসজিদের বাইরে দোকান বসেছে। চানার দোকান, ফুচকার দোকান, ঘুগনির দোকান, ঘটিঘরম, জিলিপি, পাঁপড়ভাজা, আলুকাবলি, মশলামুড়ি কত কী দোকান যে তা গুনে শেষ করা যাবে না। বাচ্চা থেকে বয়স্ক সবাই নতুন পাঞ্জাবি পাজামা, কেউ পাঞ্জাবি লুঙ্গি পরে চলেছে ঈদগার মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করতে। মুখে উচ্চারিত হচ্ছে – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবর, ওয়াল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
আকাশে বাতাসে খুশির ঢেউ। সেই ঢেউ যেন মানুষের অন্তর আর প্রকৃতির মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া প্রক্রিয়ায় আলতো আবেগে আনমনে খেলা করে চলেছে। মসজিদে ঈমাম সাহেব ঘোষণা দিচ্ছেন মাইকে – ঈদের জামাত আরম্ভ হতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে। সবাই মসজিদে চলে আসুন। জামাতের সাথে নামাজ আদায় করুন।
যথাসময়ে নামাজ হল।
নামাজের পর খুতবা শুরু হল। সবাই বসে একমনে খুতবা শুনল ঈমাম সাহেবের সুমিষ্ট গলায়। তারপর অনুদান তোলার জন্যে মসজিদ কমিটির এক একজন করে সদস্য এক এক লাইন ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। সবাই কেউ দশ টাকা, কেউ কুড়ি টাকা, কেউ বিশ, পঞ্চাশ, একশো, দুশো, পাঁচশো অবধি টাকা দিল। যাঁরা খুব বেশি পরিমাণ দিলেন তাঁরা সরাসরি মসজিদে সেক্রেটারি মশাইয়ের কাছে গিয়ে সেক্রেটারির নিজহাতে দিয়ে এলেন। হবিব মোল্লা ইদানীং বড় কারবারি হয়েছেন। বাজারে হোটেল বিশাল। তিনি দিলেন এক ঘায়ে কুড়ি হাজার টাকা মসজিদের উন্নতিকল্পে। আর এক ধনী মানুষ নজরুল ভাই দিলেন পনের হাজার টাকা। অনুদান নেবার পালা সাঙ্গ হলে দোয়া হল। মাইকে দোয়া হল। বাড়ি বউ-ঝি, মা-বোনেরা যে যার বাড়ি থেকে দোয়ায় সামিল হলেন। তারপর মসজিদের নামাজীরা ঈমাম সাহেবের সাথে প্রীতিমূলক আলিঙ্গনে আবদ্ধ হবার জন্য এগিয়ে গেল। অনেকে বাড়ি ফিরবে বলে মসজিদ থেকে বার হল।
পথে আসতে আসতে বাচ্চারা চকলেট বাজি ফাটাতে লাগল গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজে। ওরা পকেটে করে ওইসব নিয়ে নামাজ পড়তে গেছিল। কেউ দোদোমা বাজিতে আগুন দিল। একটা আওয়াজ করার পর ওই বাজি ছুটে যায় অন্য আর-এক জায়গায়। সেখানে গিয়ে আর-একবার আওয়াজ দেয়। এরকম একটা বাজি নামাজ পড়ে ফেরার বৃদ্ধ নসিমুদ্দিনের পায়ের কাছে এসে দুম ফটাস করে ফেটে উঠল। খিটখিটে নসিমুদ্দিন চেঁচিয়ে উঠলেন, “কে রে! কোন বাঁদরে এটা দিল এখানে?” তরুণ ছেলে নাসির বলল, “ও চাচা, কেউ এখানে দেয়নি ওটাকে। বাজিটা তোমায় পছন্দ করেছে। তাই দৌড়ে এসে তোমার পায়ের কাছে ফাটল।”
নসিমুদ্দিন কিঞ্চিৎ রেগে বললেন, “হ্যাঁরে চালাকি আমার সাথে? বল কে ছুঁড়ল বাজিটা এখানে।”
বাড়ি ফিরে সবাই সিমাই, কেউ লাচ্চা, কেউ পরোটা মাংস, কেউ লুচি মাংস নিয়ে বসল আয়েস করে খেতে।
একটু পরে রফিকদের বাড়িতে এল কামাল, রহিম আর সুহানা। এরা কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে সবাই। রফিকের মা রেহেনা ওদের ডাকলেন, “এই কামাল রহিম সুহানা আয়। সেমাই খেয়ে যা।”
সুহানা বলল, “ও চাচিমা সিমাই খেয়ে আসছি এইমাত্র।”
“তাহলে বোস। একটু লাচ্চা আর লুচি মাংস দিই,” রেহেনা বললেন।
দুপুরের দিকে সুহানাদের বাড়িতে রমেন, মৌমিতা আর নিখিল এল। সুহানাদের বাড়িতে হালকা খাওয়াদাওয়া করে তিনজন কামাল আর রহিমদের বাড়িতে গেল। কামাল আর রহিম ওদের ডেকে নিয়ে গেল। কামাল বলে দিয়েছিল রমেন, মৌমিতা আর নিখিলকে ওরা যেন রফিকদের বাড়িতে দম ভরে না খায়। খেলে ওদের বাড়িতে এসে ওরা তেমন খেতে পারবে না। তাই সুহানাদের বাড়িতে কেবল লাচ্ছাটাই খেল ওরা।
বিকালে রফিকের দিদি মারুফা এসে বলল রফিক, কামাল আর রহিমকে বলল, “এই তোরা খোদারবাজার যাবি না? আমি এই স্কুটি নিয়ে ঘুরে এলাম। দারুণ লাইটিং করেছে। আর মেলা বসেছে বিশাল।”
সুহানা বলল, “আপা, আমরা যাব তো। তবে এখন না সন্ধেবেলা। তুমিও আমাদের সাথে যেও।”
মারুফা আপা বলল, “না রে। তোরা এক ক্লাসের ছেলেমেয়ে। তোরা একসাথে যা। আমি গিয়ে তোদের কাবাব মে হাড্ডি হব না।”
রফিক সুহানাকে ভালোবাসে। কালকে একটা দারুণ সালোয়ার ওকে গিফট করেছে ঈদের উপহার হিসেবে। আজ সুহানা রফিককে একটা হলুদ টি-শার্ট দিল সকালবেলা। কামাল ওদের একজন ভালো ফ্রেন্ড।
রফিকের বাড়ির সবাই জানে। সুহানার বাড়িতেও। সবাই এই সম্পর্কে স্বীকৃতির শীলমোহর দিয়েছে। রফিক প্রতিষ্ঠিত হলেই বিয়ে হবে ওদের। রফিকের বাবার বড় কারখানা আছে। বেকারি কারখানা। মাস গেলে লাখ-লাখ টাকা আয়। ফলে চাকরি-বাকরির প্রশ্ন আসে না। কারখানার মালিকের চেয়ারে বসবে রফিক। আর সাথে-সাথে শাদি।
এদিকে দুপুর হয়ে এল। রফিকদের বাড়িতে ওরা তিনজনে লাঞ্চ করল। একটা ফোন এল কামালের ফোনে। রুহির কল। ফোন ধরতেই রুহি একটা কথাই উচ্চারণ করল, “আই লাভ ইউ কামাল।” কামালের মাথা ঘুরে গেল!
যে রুহির পিছনে ও এই নিয়ে চার বছর ঘুরছে। ওকে বোঝাতে পারছে না যে ও রুহিকে কতটা ভালোবাসে। সেই রুহি আজ! ওফ! ভাবা যায় না জাস্ট! আজ এই ঈদের দিনে এমন খবর!
“আই লাভ ইউ টু ডিয়ারি!” বলে কামাল “আরে ইয়া-আ-আ-” করে চিল্লে উঠল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুহানা বলল, “কী হয়েছে রে কামাল? ষাঁড়ের মতো চেল্লাচ্ছিস কেন?”
“রুহি রাজি হয়েছে। আমায় প্রপোজ়াল একসেপ্ট করেছে!”
শুনে সুহানা কামালের হাতে হাতচাপড় মেরে “ইয়াহ দারুণ!” বলে এই আনন্দটুকুর তীব্র আনুষ্ঠানিক উদযাপন করল। রফিক শুনল। বলল, “ওকে ডাক। বল বিকেলে খোদারবাজার যাচ্ছি। ও আমাদের সাথে যাবে।”
বিকেল পৌনে পাঁচটায় রুহি চলে এল একটা লাল চুড়িদার পরে। কী ভীষণ সুন্দরী মনে হচ্ছে ওকে! মনে হচ্ছে জান্নাতি হুর যেন মাটিতে নেমে এসেছে!
কামাল তাকিয়ে থাকে। রুহি এসে রফিকের ঘরে সোফায় বসল। আর একটু পরে ও কামালের সাথে-সাথে কামালের পাশে-পাশে হাঁটবে। কত গল্প করবে।
সন্ধ্যার আকাশের চাঁদটাও ওদের সাথে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে-হেঁটে চলবে ওদের মাথার ওপর আলো হয়ে। তাই কামালের এবারের ঈদটা স্পেশাল হয়ে গেল। সাথে রফিক সুহানারও।
হৃদয়ের ছোঁয়া হৃদয়ে লাগল। ঈদের খুশিতে মন ভরে উঠল।#
★ দক্ষীণ ২৪ পরগণা, ভারত।